বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
‘যেও না নবমী নিশি, আজি লয়ে তারাদলে।’
দুর্গাপুজো তো শুধু ধর্মীয় কোনও পুজো নয়, এই পুজো আসলে একটা উৎসব। প্রতিটি বাঙালির ঘরের চিরন্তন কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে এই উৎসব ঘিরে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বছরে একবারই উমা আসে বাপের বাড়িতে। ষষ্ঠী থেকে পাঁচদিন থেকে দশমীতে বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যায় শ্বশুরবাড়ি কৈলাসে। তাই দশমীটা বাঙালির কাছে দুঃখের দিন। ঘরের মেয়ে চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি। বাঙালি ঘরের প্রতিটি উমার মায়েরও তাই মন খারাপ হয়ে যায়। চোখের জলে বিদায় দেয় মেয়েকে। সেই মন খারাপের শুরু হয়ে যায় নবমীর রাতেই। অষ্টমীর পর নবমীর সারাদিন আনন্দে কাটার পর রাত হলেই মনে পড়ে যায়, কাল দশমী। উমা চলে যাবে। তাই প্রতিটি উমার মা প্রার্থনা করেন, এই রাত যেন শেষ না হয়। বলতে থাকেন, ‘যেও না নবমী নিশি, আজি লয়ে তারাদলে।’
কোভিড পরিস্থিতিতে নিউ নর্মাল সময়ে এবারের শারদোৎসব নানা নিয়মের বেড়াজালে বন্দি। মণ্ডপে ঢুকে প্রতিমা দর্শন করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া পুজোর আগে থেকে ছিল নিম্নচাপের বৃষ্টির পূর্বাভাস। ষষ্ঠী ও সপ্তমীতে মাঝে মধ্যে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি, অথবা মেঘলা আকাশ এবং হাইকোর্টে নিষেধাজ্ঞায় বাঙালি সে ভাবে পথে নামেনি। রাস্তাঘাট ছিল প্রায় শুনশান। তবে অষ্টমী থেকে অবস্থাটা বদলে গিয়েছে। করোনা সুরক্ষা বিধি মেনেই মানুষ পথে নেমেছেন। দূর থেকে মণ্ডপের ভেতরে থাকা প্রতিমা দর্শন করেছেন। যে পুজোগুলিতে মণ্ডপের ভেতরে প্রতিমা দেখা যাচ্ছে না, সেখানে রাস্তা থেকেই মণ্ডপ দেখে চলে যাচ্ছেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, কলকাতার সব জায়গার ছবিটা একই। নবমীর বিকেল পর্যন্ত ছবিটা ছিল একই রকম। তবে নবমীর রাতে নিউ নর্মালের কলকাতায় ভিড় থাকলেও অধিকাংশ মানুষেরই মন বিষাদে ভরে রয়েছে। বাতাসেও যেন বেজেছে বিষণ্ণতার সুর। সোমবার পুজো শেষ। আবার আগামী বছরের জন্য অপেক্ষা।
এরই মধ্যে অষ্টমীর সকালে প্রতিটি বাঙালিকে চমকে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। অষ্টমী উপলক্ষে তিনি টুইট করে বাঙালিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রত্যেকের সুখ–শান্তি, সুস্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধিও কামনা করেছেন তিনি। ভারতীয় হিসেবে ব্যাপারটা ঠিকই ছিল। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হল টুইটটি প্রধানমন্ত্রী মোদি করেছেন একেবারে নিখাদ বাংলাভাষায়। বিষয়টি রাজ্য বিজেপিকে খুবই আহ্লাদিত করেছে। বিজেপির গায়ে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূল যে ভাবে বহিরাগত তকমা লাগিয়ে দিতে চাইছে, তার জবাবে তারা বারবার বলছে, বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন বাঙালিই। বাংলার বাঘ হিসেবে স্বীকৃত স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কাশ্মীরে যাঁর রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে অনেকেই সন্দেহের আঙুল তুলে থাকেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর দিকে।
তবু বিজেপি কিছুতেই নিজেদের বাঙালিয়ানা যেন প্রমাণ করতে পারছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাভাষায় লেখা টুইট বিজেপি নেতাদের বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি বাড়িয়ে দিয়েছে। অষ্টমী থেকেই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে জোর চর্চা। বাংলাভাষা মিষ্টি। তাই এই ভাষায় কথা বলার লোভ সামলাতে পারেননি। ষষ্ঠীতে সল্টলেকের একটি পুজোর ভারচুয়াল উদ্বোধনে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তার ঠিক একদিন পরেই এবার বাংলায় টুইট। তৃণমূল এবং অন্য বাম দলগুলির দাবি, মোদির পাখির চোখ আসলে আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনই। সে কথা মাথায় রেখেই বাঙালির মন জয়ের চেষ্টা করছেন মোদি। বাঙালির আবেগে ধাক্কা দিতে দুর্গাপুজোকে বেছে নিয়েছেন তিনি। তবে গেরুয়া শিবির এই অভিযোগ বারবার খণ্ডন করেছেন। তাদের দাবি, কোভিড পরিস্থিতিতে চলতি বছরের পুজো একেবারেই ব্যতিক্রমী। তাই বিরোধীদের যুক্তি ভিত্তিহীন। এত চর্চার মধ্যেও নবমীর উৎসবে বাঙালি সাড়া দিয়েছে নিজেদের মতো করে। বাঁধভাঙা আবেগ ও উচ্ছ্বাস না দেখালেও নতুন জামা–কাপড় পরে ঘোরাফেরা থেকে খাওয়াদাওয়া —সবই চলেছে ধারাবাহিকতার সঙ্গেই।
উত্তর কলকাতার বাগবাজার সর্বজনীন, কুমোরটুলি সর্বজনীন, আহিরীটোলা সর্বজনীন, নলিনী সরকার স্ট্রিট, হাতিবাগান সর্বজনীন, কাশী বোস লেন, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, চালতা বাগান, তেলেঙ্গাবাগান, শ্রীভূমি, বৃন্দাবন মাতৃমন্দির, কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক, লেবুতলা পার্ক প্রভৃতি পুজোয় দুপুর থেকেই রাস্তায় জনসমাগম দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন পুজোর থিমে চমক রয়েছে এবারও। কেষ্টপুর প্রফুল্লকানন (পশ্চিম) অধিবাসীবৃন্দের মণ্ডপ এবার বলেছে লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের কষ্টের কথা। ক্লাবের সভ্যবৃন্দদের হাতের ছোঁয়াতেই সেজেছে মণ্ডপ। কেষ্টপুরের আরেক পুজো মাস্টারদা স্মৃতি সঙ্ঘের এবারের আকর্ষণ কার্তিক রূপী সুশান্ত সিং রাজপুত। অরবিন্দ সেতুর এবছরের ভাবনা সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি সিনেমাকে সামনে রেখে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের হাত ধরে ফিরেছে অপু–দুর্গা। আহিরীটোলার আর একটি নামজাদা পুজো আহিরীটোলা সর্বজনীনের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে সূর্য মন্দিরের আদলে। দমদম তরুণ দলের এবারের থিম উমা বাটি। সৃজনে শিল্পী দেবতোষ কর। সুন্দরবনেরও দুটি দুর্গাপুজো আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছেন এই পুজোর উদ্যোক্তারা।
অতিমারীকে হারিয়ে কল্লোলিনীর জেগে ওঠার গল্পই বলতে চেয়েছে দমদম পার্ক ভারতচক্রের পুজো। প্রথমবার এই পুজোকে সাজিয়েছেন শিল্পী অনির্বাণ দাস। নিউ নর্মালে পালটে দেওয়ার ডাক, সতর্ক হয়েই আনন্দে ভাসছে দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘ। এবার তাদের থিম চলো পালটাই। নেপথ্য শিল্পী পরিমল পাল। দমদম পার্ক সর্বজনীনের থিম বিনির্মাণ। সাজিয়েছেন শিল্পী কৃশানু পাল। এখানে দর্শনার্থীরা নিজের মতো করে দেখে নিচ্ছেন তাঁদের মননের দুর্গাকে। দুঃসময় কাটিয়ে আগামীর পথে এগিয়ে চলার ডাক দিয়েছে চোরবাগান সর্বজনীন। মণ্ডপসজ্জায় শিল্পী বিমান সামন্ত। প্রতিমা শিল্পী নবকুমার পাল। এবার আসা যাক অন্য একটি প্রসঙ্গে। ইতিহাস বলছে, সুলতানি আমলে বাংলায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক উৎসব, অনুষ্ঠান এবং পুজোপার্বণের ছবি ছিল আজকের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। কেউ পাকা ইটের বাড়ি বা দালান বাড়ি তৈরি করলেও নবাবের দফতর থেকে লিখিত অনুমতি আদায় করতে হত। পরে অবশ্য ইংরেজ শাসনকালে এই নিয়মের পরিবর্তন ঘটে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রাচীন হাওড়ার বর্ধিষ্ণু জনপদ আমতার নারিট গ্রামে এক ধর্মপ্রাণ নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস ছিল। আর্থিক সঙ্গতি থাকায় পরিবারের কয়েকজন দুর্গা দালান তৈরি করে বাড়িতে দুর্গোৎসব শুরু করার কথা ভাবেন। তখন বাড়িতে দুর্গাপুজো করা ছিল বেশ কঠিন।
নারিট ছোটবাড়ির প্রবীণ সদস্য শিশির ভট্টাচার্য জানালেন, আমতার নারিট গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের কয়েকজন সদস্য নবাবের দফতর থেকে পাকা দালান তৈরির অনুমতি আদায় করতে মুর্শিদাবাদে যান। বাংলার নবাব তখন আলিবর্দি খান। তিনদিন সেখানে থেকে নবাবকে পুজো করার যুক্তি বুঝিয়ে অনুমতি আদায় করে তাঁরা গ্রামে ফেরেন। এর পর দুর্গা দালান তৈরি করে শুরু হয় দুর্গাপুজো। এই পরিবারের অন্যতম কৃতী পুরুষ ছিলেন মহেশচন্দ্রন্যায়রত্ন। তাঁরই পুত্র মন্মথনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতের প্রথম অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যবন্ধু। ভট্টাচার্য পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁরই মেয়েকে প্রথম কুমারীপুজো করেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৭৭ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অবসর নেওয়ার পর কলেজের অধ্যক্ষ হন মহেশচন্দ্র। মহেশ ন্যায়রত্ন ছাড়াও এই পরিবারের অন্য কৃতীদের মধ্যে ছিলেন হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত এবং রাজনারায়ণ সিদ্ধান্তবাগীশ। এই পরিবারের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন কনৌজের উপাধ্যায়।
কনৌজ থেকে তাঁরা বীরভূমে আসেন। বীরভূমের বন্দ্য গ্রামে থাকতেন বলে তাঁরা লোকমুখে ‘বন্দ্যের উপাধ্যায়’ নামে পরিচিত হন। সেই থেকে বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যায় এই পরিবারের পদবি। পরবর্তী কালে তাঁরা ভট্টাচার্য উপাধি লাভ করেন। পরে শিয়াখালায় বসতি স্থাপন করেন তাঁরা। বর্ধমানের মহারাজা পঞ্চানন বিগ্রহ–সহ নারিটে তাঁদের জমিদারি দেন। পরবর্তী সময়ে পুজোটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বড়বাড়ি ও ছোটবাড়ি। দুটি বাড়িরই প্রাচীন দুর্গা দালান আজও আছে। নারিট ছোটবাড়ির প্রতিমা সাবেকি রীতির। দেবীকে পরানো হয় শোলার ডাকেরসাজ। এখানকার প্রতিমার বিশেষত্ব হল, কার্তিক থাকেন দুর্গার ডানদিকে এবং গণেশ বাঁ দিকে। নবপত্রিকা কার্তিকের পাশেই স্থাপন করা হয়। দেবীর বাহন এখানে পৌরাণিক নরসিংহ। আগে পশুবলির প্রথা ছিল। এখন ফলবলি দেওয়া হয়। বড়বাড়ির পুজোয় অবশ্য এখনও পশুবলিই চালু রয়েছে। পুজোয় প্রতিদিন অন্নভোগ হয়। পুজো হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে।
এবার বলা যাক আরও একটি ঐতিহাসিক পুজোর কথা। বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবাড়ির পুজো শুরু হয় আজ থেকে এক হাজারেরও বেশি বছর আগে। সালটা ছিল ৯৯৭। ওই বছর রাজা জগৎ মল্ল দেবী মৃন্ময়ীর প্রতিষ্ঠা করেন। গঙ্গামাটির সেই বিগ্রহ আজও অক্ষত। এখানে মূর্তিপুজো ছাড়াও পটে আঁকা দেবীর আরাধনা হয়। মা মৃন্ময়ী তিনটি রূপে পূজিতা হন। এই পুজো জিতাষ্টমীর পরের দিন তোপধ্বনির মাধ্যমে শুরু হয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অবশ্য পুজোর পুরনো জৌলুস আজ আর নেই। কিন্তু পুজোর আচার ও অনুষ্ঠান একেবারে তিথি ও নক্ষত্র মেনেই হয়।